রাজশাহী শুধু আম, সিল্ক আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়—এই অঞ্চল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার এক অনন্য ধারা বহন করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। প্রাচীন বঙ্গের রাজধানী থেকে শুরু করে বৌদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্র পর্যন্ত—রাজশাহীর মাটিতে লুকিয়ে আছে বহু গৌরবময় ইতিহাস।
এই লেখায় আমরা ঘুরে দেখবো রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থানসমূহ, বিশেষভাবে মহাস্থানগড় থেকে পাহাড়পুর পর্যন্ত।
মহাস্থানগড় – প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরী
-
📍 অবস্থান: শিবগঞ্জ, বগুড়া
-
🕰️ প্রতিষ্ঠা: খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক
-
🏛️ বিশেষত্ব: এটি ছিল প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজধানী—পুণ্ড্রনগর।
এখানে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে জানা যায়, মোর্য, গুপ্ত ও পাল রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন। এখানে আছে গোকুল মেধ (বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনির নিদর্শন), সিংহদ্বার, এবং জাদুঘর। মহাস্থানগড়কে বলা হয় বাংলাদেশের "ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের রাজধানী।"
পাহাড়পুর – সোমপুর মহাবিহার
-
📍 অবস্থান: বদলগাছী, নওগাঁ
-
🕰️ প্রতিষ্ঠা: ৮ম-৯ম শতক (ধর্মপাল, পাল রাজবংশ)
-
🏛️ বিশ্ব ঐতিহ্য: UNESCO World Heritage Site
পাহাড়পুর ছিল প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মীয় ও শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। এখানে রয়েছে বিশাল বৌদ্ধ বিহার, একসময় যেখানে হাজারো ছাত্র অধ্যয়ন করতেন। এর স্থাপত্যশৈলী ভারত, নেপাল ও চীনেও প্রভাব ফেলেছিল।
এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ।
বাঘা মসজিদ – সুলতানি স্থাপত্যের নিদর্শন
-
📍 অবস্থান: বাঘা, রাজশাহী
-
🕰️ প্রতিষ্ঠা: ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দ (সুলতান নাসির উদ্দিন নসরত শাহ)
-
🏛️ বিশেষত্ব: টেরাকোটার কাজ, পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট স্থাপত্য
বাঘা মসজিদ একদিকে যেমন ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে, অন্যদিকে এটি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর মুঘল-পূর্ব মসজিদ স্থাপত্য। এটি এখনও নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।
তাহখানা কমপ্লেক্স – মোঘল আমলের রাজকীয় স্থাপত্য
-
📍 অবস্থান: বাঘা থানার নিকট কুঠিপাড়া
-
🕰️ প্রতিষ্ঠা: ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ (শাহ শুজার আমলে)
-
🏛️ বিশেষত্ব: মোঘল শীতকালীন প্রাসাদ, স্নানঘর ও পুকুরঘাট
তাহখানা কমপ্লেক্স একটি রাজকীয় আবাসস্থল, যেখানে রাজপরিবার শীতকাল কাটাতেন। এর ভেতরে রয়েছে পাথরের প্রাসাদ, দোতলা ভবন ও মসজিদ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারুস সালাম মসজিদ
-
📍 অবস্থান: শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
-
🕰️ প্রতিষ্ঠা: ১৬শ শতক
-
🏛️ বিশেষত্ব: প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যশৈলী ও ঐতিহ্য
এই মসজিদ এলাকাটি একসময় ছিল গৌড় নগরীর অংশ। মুসলিম শাসনের সময় বহু দৃষ্টিনন্দন মসজিদ ও ইমারত এখানে গড়ে ওঠে।
গৌড় নগরী – এক হারিয়ে যাওয়া রাজধানী
-
📍 অবস্থান: শিবগঞ্জ, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত
-
🕰️ প্রতিষ্ঠা: মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসনামল
-
🏛️ বিষেশত্ব: ইদ্রাকপুর, ছোট সোনা মসজিদ, ফতেহাবাদ
গৌড় একসময় ছিল বাংলার রাজধানী। এখানে মুসলিম শাসকদের বহু প্রশাসনিক ভবন ও মসজিদ তৈরি হয়েছিল, যেগুলোর অনেক অংশ আজও টিকে আছে।
উপসংহার
রাজশাহীর প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থান শুধু ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং অতীতের এক জীবন্ত ইতিহাস। এই অঞ্চল একদিকে যেমন প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতা ধারণ করে, অন্যদিকে মধ্যযুগীয় মুসলিম স্থাপত্যের গৌরবময় চিত্রও তুলে ধরে।
এইসব স্থানে ভ্রমণ করলে আপনি পাবেন বাংলার ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের অপূর্ব মিলন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন